বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলসহ অনেকেই এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও বর্তমান সরকারের উপদেষ্টারা বারংবার বলছেন প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই হবে নির্বাচন। তবে, এর আগে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার করে যেতে চাইছে সরকার। এজন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঙ্খিত সংস্কারের সে পথ সহজ হচ্ছে না মোটেই।
শুক্রবার (১৬ মে) এক প্রতিবেদনে এমনই এক বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার। এ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার, যার প্রধান হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইতোমধ্যে এ সরকারের অধীনে ৯ মাস কেটে গেছে বাংলাদেশের। তবে, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সংস্কার কিংবা জুলাই গণহত্যার বিচার কোনটাতেই এখন পর্যন্ত তেমন কোনও সাফল্য নেই সরকারের।
এ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ১৬ বছরের একটানা ‘ভূমিকম্পের’ মতো আতঙ্কের রাজনৈতিক শাসনের পর বাংলাদেশের সামনে এখন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যা কিছু ধ্বংস হয়েছে, তা মেরামত করার চেষ্টায় আছি আমরা। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশাবাদী। তবে, এসব বাস্তবায়ন মোটেও সহজ হচ্ছে না।
শেখ হাসিনার পতনের পর সামনে আসে তার সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র। একটি শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়, তার শাসনামলে প্রতি বছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও গণহত্যার অভিযোগে একাধিক মামলা চলছে, যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দেশের সব রাজনৈতিক দলই এমন অনিয়ম প্রতিরোধে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি তুলেছে। তবে বিপ্লবের ৯ মাস পরেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা কঠিন হয়ে পড়েছে।২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা ও সংবিধান ইত্যাদি নিয়ে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করেন ড. ইউনূস। এসব কমিশনে নাগরিক সমাজ ও শিক্ষাজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুক্ত রয়েছেন। কমিশনগুলোর সুপারিশ বিশ্লেষণ করতে গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এ পর্যন্ত তারা ১৬৬টি সুপারিশ সংগ্রহ করেছে ও ৩৫টি রাজনৈতিক দলের মতামতও নেওয়া হয়েছে।
এই কমিশনের কাজ হলো- জুলাই মাসের মধ্যে একটি ‘চার্টার অব কনসেনসাস’ প্রণয়ন করা, যা আগামী নির্বাচন ও ‘নতুন বাংলাদেশ’র রূপরেখা নির্ধারণ করবে।
তবে, ঐকমত্য গড়ে তোলা সহজ হচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করছেন, টেক্সটাইল বা শিক্ষা খাতে কোনো কমিশন না থাকা ভুল হয়েছে। সবচেয়ে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে নারীদের অধিকার বিষয়ক কমিশনের সুপারিশ, যা ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে। এর জেরে কট্টর ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখনো দুর্বল। এছাড়া, দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে, রাজপথে প্রতিবাদ যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিনের চিত্র।
এরই মধ্যে বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এরপরই দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। ফলে, তারা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে, আওয়ামী লীগের সমর্থন এখনও রয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, চাইলেই কোনও রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শকে নস্যাৎ করা যায়। এই অন্তর্বর্তী সরকার জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে ক্ষমতার বাইরে থেকেও পুণরায় সংঘটিত হতে পারে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার এবং এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় দলগুলোও দাবি করছে, সংঘটিত হয়ে দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে মরিয়া হয়ে আছে ক্ষমতাচ্যুত দলটি।
এ অবস্থায় সংস্কারের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বেশ কণ্টকাকীর্ণ পথ অপেক্ষা করছে বলেই মত অনেকের।আরটিভি