
প্রতীকী ছবি
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ১২ দিনের এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে আবারও নতুন করে গভীর উৎকণ্ঠায় ভুগতে শুরু করেছে ইসরায়েল। যেকোনোভাবে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের অগ্রগতি বন্ধ করে দিতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে মার্কিন মদদপুষ্ট দেশটি। এরই মধ্যে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে কড়া এক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরায়লের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়া।
বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে টাইমস অব ইসরায়েল।
ইরান পুনরায় যেন তার পারমাণবিক প্রকল্প শুরু করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) জেরুজালেমে মোসাদ এজেন্টদের এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বার্নিয়া বলেন, পারমাণবিক বোমা তৈরির ভাবনা এখনো ইরানের হৃদয়ে রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের যে মারাত্মক ক্ষতি করেছি, তা যেন আর কখনোই সচল হতে না পারে, সেই দায়িত্ব আমাদেরই পালন করতে হবে।
আগামী বছরের জুনে বিদায় নিতে যাওয়া ইসরাইলের এই গোয়েন্দাপ্রধান যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইলের আকস্মিক হামলার প্রশংসা করেন। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, ওই হামলার মাধ্যমেই বোঝা গেছে ইরানে ইসরাইলি গোয়েন্দাদের কত গভীর অনুপ্রবেশ ছিল।
বার্নিয়া বলেন, ‘আয়াতুল্লাহর শাসনব্যবস্থা হঠাৎ টের পায় যে, ইরান পুরোপুরি উন্মোচিত এবং সেখানে আমরা গভীরভাবে ঢুকে পড়েছি।’
তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সমাধান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘ইরান বিশ্বকে আবারও ধোঁকা দিতে চায় এবং আরেকটি ত্রুটিপূর্ণ পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চায়। আমরা অতীতেও এমন কোনো খারাপ চুক্তি হতে দেইনি এবং ভবিষ্যতেও দেব না।’
মোসাদপ্রধানের এমন হুঁশিয়ারির পর আরও ঘনীভূত হয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা। এমনকি সম্ভাব্য সেই সংঘাত রূপ নিয়ে পারে সর্বাত্মক যুদ্ধেও। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন।
হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।
গত এক মাসে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা নিয়ে সতর্কবার্তা জোরালো হয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও কিছু বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রক্সি ফ্রন্ট বিস্তৃত করছে এবং কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্তমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়া। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেহরানের দাবি অনুযায়ী তারা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, এর একটি অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে—তাদের মতে, ইরানে ইসরায়েলের আরেকটি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, হামলা ‘কবে হবে’—সেটাই বড় প্রশ্ন। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তেল আবিবের এই মনোভাব সামরিক হামলার সম্ভাবনাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তার ইরানি সূত্র অনুযায়ী দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো দিনে ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। তার ভাষায়, নতুন কোনো সংঘাত হলে ইরান আগের মতো ১২ দিনে ৫০০টি নয়, বরং একযোগে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে উত্তেজনা প্রায় কাঠামোগতভাবেই অনিবার্য।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কার্সরইনফোর বরাতে জানা যায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
উল্লেখ্য, পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টার অভিযোগ এনেছে। তবে, তেহরান সব সময়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সবশেষ গত ১৩ জুন ওয়াশিংটন এবং তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনার প্রক্রিয়া চলাকালীন, ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে বিনা উসকানিতে আগ্রাসন শুরু করে। ইসরাইলি আক্রমণের ফলে ১২ দিনের যুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে দেশটিতে কমপক্ষে ১ হাজার ৬৪ জন নিহত হন। যাদের মধ্যে সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং বেসামরিক নাগরিকও ছিলেন।
আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করে তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সংঘাতে জড়ায়। এর জবাবে দখলকৃত অঞ্চলজুড়ে কৌশলগত স্থানগুলোর পাশাপাশি কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ইরানি সশস্ত্র বাহিনী।