Nazrul Islam
নজরুল ইসলাম
১ ) বিশ্বের জনসংখ্যা গণনা অনুসারে বাংলাদেশ অষ্টম জনবহুল দেশ । এ দেশে ১৭-১৮ কোটি মানুষের বাস যার ৪৯.% পুরুষ এবং ৫১ % মহিলা । অপরদিকে কানাডা যদিও আকারে পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ দেশ, লোক সংখ্যা মাত্র চার কোটি।
২ ) বাংলাদেশে যুব শ্রমশক্তির অর্ধেকের ও বেশি বেকার, পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী,বেকারের সংখ্যা ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত ২৬.৬ লাখে বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০২৩ সালের একই সময়ে ২৪.৯ লাখ ছিল। এই বেকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সরকারের কি পরিকল্পনা বা মাথাব্যথা, তা জানার আগ্রহ নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি । প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে হন্যাহয়ে কাজের জন্য দৌড়াচ্ছে এবং ব্যর্থ হয়ে কাজ না পেয়ে মাবাবা ও সমাজের উপর চাপের সৃষ্টি করছে। কথায় বলে “An Idle Mind Is the Devil’s Workshop” একটি অলস মস্তিস্ক হচ্ছে শয়তানের কর্মস্থল। মানুষের বাঁচার জন্য দৈনন্দিন টাকাপয়সার দরকার হয়। কাজ না থাকা মানুষ অসহায় ,সে ক্ষেত্রে চুরি- ডাকাতি বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে- এটা অস্বাভাবিক কিছু না; এর জন্য সরকার দায়ী। যদি স্কুল,কলেজ,বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে ছেলেমেয়েরা মাবাবার উপর বার্ডেন হয়ে বসে থাকতে হয়,তা হলে সে শিক্ষার কি মূল্য ? আমাদের সরকারকে উদ্যোগী হয়ে ছেলেমেয়েদের বাস্তবমুখী শিক্ষা দিয়ে কাজে লাগানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
৩ ) কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরী করা দরকার । আজকালকার জগতে শুধু শ্রেণীকক্ষে পাঠজ্ঞান যথেষ্ট নয় - ছেলেমেয়েকে স্ব-নিযুক্তির প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। এতে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা শেষে চাকুরী না খুঁজে উদ্যোক্তা হিসাবে ও ব্যস্ত থাকবে।নতুন উদ্যোক্তা তৈরীতে যথেষ্ট সময় নিয়ে কাজ করার প্রবণতা তৈরী করতে হবে। যে যত বড় ব্যবসায়ী হোক না কেন - হঠাৎ করে কেউ বড় হয় নি , ছোট থেকে সবাই ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
একটি দেশের জন্য নিম্নবর্ণিত উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ :
ক) স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি খ) মানবসম্পদ অর্থাৎ জনশক্তি উন্নয়ন, গ) অবকাঠামো উন্নয়ন, ঘ) প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সুষম প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করণের মাধ্যমে।
ক) স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি : একটি দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কেন প্রয়োজন ?
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বলতে সরকারের ক্ষমতা থাকাকালীন সময় নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতা বোঝায় , অস্থিতিশীল সরকারের পক্ষে দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা কঠিন । রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে বিদেশী বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও হ্রাস পায়। বিদেশী বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন এবং তা একমাত্র স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে আশা করা যেতে পারে।
খ) মানবসম্পদ উন্নয়ন : মানবসম্পদ (Human Resources) বলতে দেশের কর্মক্ষম জনগুষ্ঠীকে বুঝানো হয় ; কর্মক্ষম জনগুষ্ঠী তাদের কাজের দক্ষতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য সমষ্টিগতভাবে বোঝায়।
প্রতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে কর্মক্ষম মানবসম্পদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরের কর্মীরাই মানবসম্পদের অংশ।কর্মীদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, যোগ্যতা, কাজের বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান,অভিজ্ঞতা এবং শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য না থাকলে আশান্বিত কাজ আদায় করা যায় না। উন্নত দেশগুলিতে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ শিখানো হয় এবং এই জাতীয় শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।
গ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development) বলতে একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিবর্তন, দেশের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবার উন্নয়ন এবং সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বুঝায় ।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া বলতে - বিভিন্ন খাতে শিল্পায়ন, কৃষি উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন অন্তর্ভুক্ত করা । এটি দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন নীতি ও কৌশলকে নির্দেশ করে- তা একমাত্র জবাবদিহি সরকারের মাধ্যমে সম্ভব ।
৪ ) উন্নত দেশগুলির উদাহরণ দিতে গেলে - কানাডার মতো দেশগুলিতে স্কুল কলেজ বা ইউনিভার্সিটি তে পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করে । যেমন : হসপিটালিটি বা আতিথেয়তা প্রোগ্রাম নিয়ে যারা পড়াশুনা করে তাদের সময় সময় বিভিন্ন হোটেলে প্রাকটিক্যাল কাজ শিখানো হয়। এ ছাড়া মেডিকেল , দাঁতের চিকিৎসা , নার্সিং,একাউন্টিং এবং নানাহ কোম্পানি বা ফ্যাক্টরি জব রিলেটেড বিভিন্ন সফটওয়্যার শিখানো হয়, পড়াশুনার শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টারভিউ নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার সুযোগ থাকে।
৫ ) নিয়মিত পড়াশুনার সময় কিছু ঐচ্ছিক কোর্স বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য শিখানো যেতে পারে : ইলেক্ট্রিসিয়ান , প্লাম্বারিং, টেলারিং, বিউটি পার্লার, হসপিটালিটি, একাউন্টিং ও সফটওয়্যার –এছাড়াও আরও অন্যান্য কোর্সও রয়েছে যেগুলির কোনো একটা বা দুইটা কোর্স যদি ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনে শিখে বের হয়, তাতে দেশে ও বিদেশে গিয়ে কাজ পেতে সুবিধা হবে। কানাডাতে এ জাতীয় কোর্স (কাজের প্রশিক্ষণ) শিখানো হয় এবং এতে দ্রুত কাজ পেতে সাহায্য করে । উদাহরণ স্বরূপ- এ দেশে অনেক স্কুলে অটো-মেকানিক এর কাজ শিখানো হয় এবং স্কুল শেষ করে ছেলেরা পরবর্ততে এই ফিল্ডে কাজ শিখে সরাসরি কাজে ঢুকে পড়ে।
৬ ) পলিটেকনিক : বাংলাদেশে অনেক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে যেখানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং,নির্মাণ প্রকৌশল-ইলেকট্রনিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিংফ্রিজারেশন এবং এয়ার কন্ডিশন প্রযুক্তি শিখানো হয়। ছেলেমেয়েরা বিএ বা এম এ পাশ করে বেকার ঘুরাঘুরি করে, যদি স্বাধারণ ডিগ্রী নেয়ার সাথে টেকনিকাল বা প্রযুক্তিগত বিষয়ে কিছু শিখে -দেশে এবং বিদেশে কাজ পেতে সহজ হয়।
৭ ) ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ITI ) : হাতে কলমে পড়াশুনা যেমন ইলেকট্রিকাল ওয়ারিং, মেশিন ওয়ারিং- এ জাতীয় বিভিন্ন ধরণের কাজ শিখানো হয়। এ সব হাতের কাজ শিখলে কোনো লোক বেকার থাকে না।
কিন্তু আমাদের দেশে এ জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বল্পতার জন্য ছেলেমেয়েরা সুযোগ পায় না বা ছেলেমেয়েদের মধ্যে আগ্রহ থাকে না -ওরা বড় বড় ডিগ্রীর পেছনে ঘুরে অযথা সময় নষ্ট করে।
ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র : ঢাকা এবং অন্যান্য শহর এবং উপশহর গুলিতে আজকাল কিছু ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে ছেলেমেয়েদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। এ ছাড়া আরও অনেক ট্রেড স্কুল খোলা দরকার যেখানে ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার সুবিধা থাকবে । কাজ শিখলে দেশে এবং বিদেশে কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারে। আমাদের সরকারকে এ জাতীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ করে দেবে এই আশা করি ।
কানাডাতে পড়াশুনা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে চাকরির সুবিধার্থে কোম্পানির সাথে সহযোগিতা করে ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করে । এতে করে শিক্ষা নবীশরা পড়াশুনা করে সরাসরি কাজে যোগদান করতে পারে।
বাংলাদেশে যেহেতু অধিক লোকসংখ্যা এবং চরম বেকার সমস্যা, তাই চান্দাবাজ, ধান্দাবাজ,দুর্নীতি,এ সব থেকে দেশকে রক্ষা করা কঠিন, শুধু আইন(সংস্কার ) করে বা ধর্মের বাণী শুনিয়ে কাউকে ফিরানো যায় না।
৮ ) কানাডা ১৮ বৎসর বয়স যুবক বা যুবতী থেকে শুরু করে প্রতি টি লোককে বাধ্যতামূলক বাৎসরিক ইনকাম ট্যাক্স ফর্ম (আয় কর ফর্ম পূরণের পর ) জমা দিতে হয়। এতে সরকার প্রতিটি লোকের আর্থিক অবস্থা,বেকার সমস্যা অনুধাবন করতে পারে। তার উপর নির্ভর করে সরকার কমিউনিটি প্রশিক্ষণ ও কাজের ব্যবস্থা করে। প্রতিটি লোকের আর্থিক অবস্থার উপর বিবেচনা করে তাদের সরকারি বাড়তি সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
আশা করি বাংলাদেশ সরকার ছেলেমেয়েদের প্রতি বিশেষ দৃর্ষ্টি রেখে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বেকারত্ব হ্রাস করে দেশকে এগিয়ে নেবে ; এতে বেকার ছেলেমেয়েরা সঠিক পথে এগিয়ে যাবে এবং অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে । দেশের দুর্নীতি এবং অরাজকতার জন্য আমাদের সরকার এবং সমাজ দায়ী - এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।