বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। ছবি : এক্স থেকে নেওয়া
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যখন সুদিন ছিল, সেই ১৯৭৬ সালে প্রথম সরকারি অনুদান পেয়েছে মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি'। তখন অনুদান নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এবারও রাষ্ট্রীয় অনুদান প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস প্রায় পাঁচ দশকের। এ তালিকায় রয়েছে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী', ‘দহন', ‘আগুনের পরশমনি'র মতো ছবি। দেশীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানবিক মূল্যবোধ তুলে ধরা আর নতুন নির্মাতাদের উৎসাহিত করতে নান্দনিক ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রতিবছর অনুদান দিচ্ছে সরকার। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে আবারও নিয়মিত হয় অনুদান। তখন থেকেই এতে রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে শুরু করে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এখনও অনুদান সেই স্বজনপ্রীতির দূষণ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে কিনা প্রশ্ন রয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও ২০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির প্রত্যেক প্রযোজক ৭৫ লাখ টাকা ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা ২০ লাখ টাকা করে পাবেন। সব মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ৯ কোটি টাকা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শিল্পমান ও নির্মাণযোগ্যতা উপেক্ষা করে এবার অনুদান দিয়েছে সরকার। এ নিয়ে নির্মাতা, সমালোচক ও চলচ্চিত্রকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন কমিটিতে যুক্ত কয়েকজন নির্মাতার অনুদান পাওয়া, একদিনেই সুপারিশকৃত সব ছবির নির্মাতাদের পিচিংয়ে (সাক্ষাৎকার) ডাকা, অনুদান কমিটিতে আমলাদের আধিক্য ও বিভিন্ন সময়ে কমিটির চার সদস্যের পদত্যাগের ঘটনা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া প্রযোজকের নাম ছাড়া কোনও ছবির পরিচালকের নাম প্রজ্ঞাপনে না থাকার বিষয় সমালোচিত হয়।
সরকারি অনুদান পেতে একেকটি চিত্রনাট্য জমাদানে ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদসহ ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয় নির্মাতাদের। নীতিমালা অনুযায়ী– জমা পড়া পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করে থাকে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই ও তত্ত্বাবধান কমিটি' এবং ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই ও তত্ত্বাবধান কমিটি'। বাছাইকৃত গল্প/চিত্রনাট্য ও আবেদন অনুদান কমিটির সদস্যরা মূল্যায়ন করে আলাদাভাবে নম্বর দেন। কমিটির সব সদস্যের মূল্যায়নকৃত নম্বরের যোগফলের ভিত্তিতে উপযুক্ত প্রকল্পগুলো অনুদানের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। এরপর সেসব চিত্রনাট্যের প্রযোজক-পরিচালকদের পিচিং করতে হয়। তাদের ভাবনা জেনে তথ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন ছবিগুলো সরকারি অনুদান পাবে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে এসব প্রক্রিয়া মেনে চলা হয়েছে কিনা প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।
এবার পূর্ণদৈর্ঘ্য শাখায় ১৮৯টি ও স্বল্পদৈর্ঘ্য শাখায় ১৪০টি চিত্রনাট্য জমা পড়ে। এর মধ্য থেকে ৯৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও ৯০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। গত ২৯ জুন সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ৯৫ জন আবেদনকারী নির্মাতার পিচিং (সাক্ষাৎকার) করার তথ্য ফেসবুকে জানান অনুদান কমিটির সদস্য, কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী।
প্রশ্ন ওঠে, একদিনেই এতসংখ্যক আবেদনকারীকে ডাকা কতটা যুক্তিসঙ্গত? কারণ একেকজন ৫ মিনিটের বেশি সময় পাননি। ২০২২ সালের জাতীয় পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র স্বীকৃতি পাওয়া ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া'র পরিচালক মুহাম্মদ কাইউম তাদেরই একজন। এবার অনুদানের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বাদ পড়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচটি প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর উত্তরসহ যার যার প্রকল্পকে তুলে ধরে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে বলে দেয়। কিন্তু এত কম সময়ে সব যথাযথভাবে দেখানো যায়নি। স্লাইডগুলো একটান দিয়ে দেখে শেষ করেছেন তারা। সেগুলোতে কী লেখা আছে সেসব পড়ার সময় দেওয়া হয়নি। প্রশ্নগুলোর উত্তর যথাযথভাবে জানতে চাওয়া হয়নি আর সেগুলো পড়েনও নাই। পুরো প্রক্রিয়া দেখে আমি বিস্মিত।'
সরকারি অনুদান প্রক্রিয়ায় শুভঙ্করের ফাঁকি দেখছেন পরিচালক খন্দকার সুমন। তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘সাঁতাও' নেপাল চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র হিসেবে গৌতম বুদ্ধ পুরস্কার জিতেছে। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘অনুদান প্রক্রিয়া আয়োজন করা হয় প্রকাশ্যে। কিন্তু বিলি-বন্টন হচ্ছে নিজেদের গণ্ডিতেই। রাজনৈতিক কোটা ও আমলা কোটাকে ঢাকতে দুই-একটি ছবিকে নিরপেক্ষভাবে অনুদান দেওয়া হয়। এমন অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে দেখেছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলাম, যেখানে দলীয় প্রভাব থাকবে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সেই একই চিত্র দেখছি এখনও। অনুদান পদ্ধতি দেখেই বুঝেছি, সাধারণ মানুষের চোখে ধুলা দেওয়া হচ্ছে। বাছাই কমিটির একজন সদস্যের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, কারা অনুদান পাবে সেই তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে আগেই করে রাখা হয়েছে। তাই ৫ মিনিট করে একদিনেই ৯৫টি ছবির পিচিং ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। ড্রামাটিক স্বচ্ছতা দেখাতে গিয়ে এই অঘটন ঘটিয়েছে মন্ত্রণালয়। এত কম সময়ে পিচিং হয় না। অনুদানের অর্থ এখন বেশি হওয়ায় মৌসুমি প্রযোজক বেশি দেখা যাচ্ছে। যেখানে মধু বেশি, সেখানে মাছিও বেশি থাকে।’’
যদিও পিচিংকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অভিনেতা-নির্মাতা তারিক আনাম খান। তবে সবাইকে যথাযথভাবে সময় দেওয়ার পক্ষে তিনি। তার মতে, ‘‘এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে অবশ্যই ভালো ফল আসতে পারে। তবে একদিনেই সবাইকে পিচিং করতে বললে সেটি যথাযথভাবে হওয়ার কথা না।’’
পুনর্গঠিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদানের স্ক্রিপ্ট বাছাই কমিটির সদস্য লেখক-সাংবাদিক মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অনেক ভালো প্রকল্প জমা দেওয়া প্রযোজকের পিচিং হয়তো ভালো হয়নি। ভালো হলেও হতে পারে অনুদান কমিটির কাছে ভালো লাগেনি। পিচিংয়ের নম্বরে সঙ্গে আমাদের নম্বর যোগ হয়নি। সেটি হলে হয়তো ভালো প্রকল্প ও ভালো উপস্থাপনার সমন্বয়ে ফল হতো। আমরা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা দুই কমিটির নম্বর যোগ করার বিষয়ে আগামীতে ভাববে বলে আমাদের জানিয়েছে। আশা করি, ধীরে ধীরে অনুদানকে আরও স্বচ্ছতার দিকে নেওয়া যাবে।’’
এবার সাধারণ শাখায় অনুদান পেয়েছে ১০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এরমধ্যে ‘অদ্বৈত'র প্রযোজক সাদিয়া খালিদ ঋতি চলচ্চিত্র বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদান স্ক্রিপ্ট বাছাই কমিটির সদস্য। ‘অতিথি'র প্রযোজক মো. আবিদ মল্লিক চলচ্চিত্র অনুদান উপ-কমিটির সদস্য। ‘আশার আলো'র প্রযোজক মো. আরিফুর রহমান চলচ্চিত্র বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য।
সাধারণ শাখায় অনুদান পেয়েছে ৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এরমধ্যে ‘কবির মুখ: দ্য টাইম কিপার'-এর প্রযোজক মুশফিকুর রহমান চলচ্চিত্র বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য। রাজনৈতিক ইতিহাস তথা আবহমান বাংলার সকল রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও বিপ্লব যা এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নিয়ামক সংক্রান্ত শাখায় তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান পেয়েছে। এরমধ্যে ‘ভরা বাদর'-এর প্রযোজক মোহাম্মদ সাইদুল আলম খান তথ্য মন্ত্রণালয় সংস্কারে সার্চ কমিটির সদস্য। প্রামাণ্যচিত্র শাখায় ৭৫ লাখ টাকা অনুদান পাওয়া ‘মায়ের ডাক'-এর প্রযোজক লাবিব নাজমুস ছাকিব ফিল্ম আর্কাইভ বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য।
অনুদান কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠায় ব্যাখ্যা দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তাদের দাবি, ‘‘পূর্ণদৈর্ঘ্য/স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা, ২০২৫' মেনেই অনুদানের জন্য চলচ্চিত্র নির্বাচন করা হয়েছে। অনুদান কমিটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে অনুদানের জন্য চলচ্চিত্র বাছাই করেছে।''
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পূর্ণদৈর্ঘ্য/স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা, ২০২৫-এ ‘চলচ্চিত্র অনুদান উপকমিটি' নামে কোনও কমিটি নেই। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের গঠিত সার্চ কমিটির মেয়াদ কয়েক মাস আগেই শেষ হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, "সাদিয়া খালিদ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করেন। তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই ও তত্ত্বাবধান কমিটিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই ও তত্ত্বাবধান কমিটির সদস্য। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অন্য কোনো কমিটির সদস্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারবেন না— এমন কোনো বিষয় ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য/স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা, ২০২৫'-এর কোথাও উল্লেখ নেই।”
তবে মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যাকে বানোয়াট ও মিথ্যা অভিহিত করেছেন খন্দকার সুমন। একইভাবে মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যাকে যথাযথ মনে করেন না মুহাম্মদ কাইউম। সরকারি বিভিন্ন কমিটিতে যুক্ত থেকে অনুদান নেওয়াকে স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) হিসেবে দেখছেন তার মতো অনেকে। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘সরকার বদলালেও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। কারণ নিয়ম-নীতির কোনও বালাই নেই। তাড়াহুড়া করে স্বচ্ছতা ছাড়াই অনুদান দেওয়া হচ্ছে।''
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত চলচ্চিত্রকর্মীদের সামষ্টিক প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ' মনে করে, ‘‘যারা সরকারি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কমিটিতে থাকবেন, তাদের একই অর্থবছরে অনুদানের জন্য আবেদন বা প্রাপ্তির সুযোগ থাকা উচিত নয়। তাদের নিকটজনেরাও একই সময়ে অনুদান নিতে পারবেন না বিষয়ক বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।''
পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অনুদান কমিটির সদস্য পরিচালক-প্রযোজক আকরাম খানের ব্যক্তিগত মতামত, ‘কমিটিতে থাকা কাউকে অনুদান না দেওয়াই ভালো। এটা আইন করে বন্ধ করতে পারলে আর বিতর্ক তৈরির সুযোগ থাকবে না। সেমিনারের মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনের প্রবীণদের ডেকে তাদের পরামর্শ নিয়ে সংস্কার অনুমোদন করা উচিত।'
তবে নৈতিক সংঘাতের বিষয়টি মানতে নারাজ শিশুতোষ শাখায় অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রবিনহুডের আশ্চর্য অভিযান'-এর কার্যনির্বাহী প্রযোজক মো. আবিদ মল্লিক। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘প্রতিবছর অনুদান প্রক্রিয়াকে ঘিরে ব্যাপক হট্টগোল ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। যারা অনুদান বঞ্চিত হন তারাই অহেতুক বিতর্ক করেন। এবারও যারা অনুদান পাননি, তারাই সমালোচনা করছেন।''
অনুদানের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনুদান কমিটির সদস্যরাই অনুদান পেয়েছেন, এ বিষয় নিয়েই মূলত বেশি সমালোচনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মো. আবিদ মল্লিক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘অনুদান উপ-কমিটির আগে নাম ছিল প্রিভিউ কমিটি। কারণ, এই কমিটির কাজ হলো, আগে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের নির্মিত ছবি ঠিকঠাকভাবে হয়েছে কিনা সেসব দেখা। সংস্কারের সময় উপ-কমিটি নাম দেওয়া হয়েছিল। এখন কী নাম হয়েছে জানি না। তবে পাণ্ডুলিপি নির্বাচনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নাই। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, কেউ যদি স্বল্পদৈর্ঘ্য বাছাই ও অনুদান কমিটিতে থাকে, তিনি চাইলে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির জন্য আবেদন করতে পারবেন। একইভাবে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাছাই ও অনুদান কমিটিতে থাকা সদস্য স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির জন্য আবেদন জমা দিতে পারবেন। আমি আবেদন জমা দেওয়ার আগে এই বিষয় পরিষ্কারভাবে জেনে নিয়েছি। ছবি নির্মাণ করাই আমার মূল কাজ। কমিটিতে থাকার কারণে যদি অনুদানের আবেদন কিংবা ছবি নির্মাণ করা না যায় তাহলে তো থাকবো না। কারণ, কমিটির সদস্য হিসেবে থাকা তো বেতনভুক্ত কোনও কাজ না। এটা তো আমার পরিচয়ও না। সরকারি কমিটিতে থাকা মানে সরকারের পক্ষে থাকা যারা ভাবছেন, সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমরা নীতিনির্ধারকের জায়গায় নাই।''
পুনর্গঠিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অনুদান কমিটি থেকে বিভিন্ন সময়ে পদত্যাগ করেন অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম, নির্মাতা-চিত্র সম্পাদক সামির আহমেদ, অভিনেতা-নির্দেশক তিতাস জিয়া, রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি ও ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল। তবে আকরাম খান ও পরিচালক-চিত্রনাট্যকার নার্গিস আখতার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথমবার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে আকরাম খান ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এবার অর্থবছর ধরার জন্য কিছুটা তাড়াহুড়া করতে হয়েছে। তাই আগামীতে এমন হুড়োহুড়ি করা যাবে না। তাতে যতই স্বচ্ছতা রাখার চেষ্টা থাক না কেন, ভুল হতে পারে। তবে আমি স্বচ্ছতা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমার তরফ থেকে কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি। কারও তদবির শুনিনি। আমার শুধু নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। আমরা কমিটির কেউই কিন্তু অন্যের নম্বর জানতে পারিনি।''
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপের দাবি, ‘‘সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে চূড়ান্ত অনুদানপ্রাপ্তদের নম্বরসহ প্রতিটি ধাপে সকল বিচারকের প্রদত্ত নম্বর জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। চূড়ান্ত নম্বরের মানদণ্ড কী ছিল, তা স্পষ্টভাবে জানানো হোক। প্রস্তাবনা, পূর্ব অভিজ্ঞতা নাকি কেবল কয়েক মিনিটের পিচিং– কোন ভিত্তিতে কাকে কত নম্বর দেওয়া হলো পরিষ্কার করা জরুরি। প্রযোজক-পরিচালকদের জন্য একটি কাঠামোগত আপিল প্রক্রিয়া রাখতে হবে, যেখানে তারা প্রাপ্ত নম্বর বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পাবেন এবং এজন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।''
এদিকে দর্শক খরায় দেশের প্রায় দেড় হাজার প্রেক্ষাগৃহ থেকে একের পর এক বন্ধ হতে হতে চলচ্চিত্রে দুর্দিন নেমে এলো। সেই সংখ্যা এখন ৭০-এ এসে নেমেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দিয়েও তাতে প্রাণ ফেরানো যায়নি খুব একটা। দেশীয় চলচ্চিত্র এখন এমন এক মরণব্যাধিতে আক্রান্ত! তারিক আনাম খান প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়াকে চলচ্চিত্র শিল্পের অন্তরায় মনে করেন। তার মন্তব্য, ‘‘এ নিয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করছি না। ঈদের সময় কিছু প্রেক্ষাগৃহ বাড়ে। তারপর আবার তালা ঝোলে। দুই ঈদের ওপর ভর করে চলচ্চিত্র শিল্প টিকে থাকতে পারে না।''
চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ঘটাতে অনুদান দেওয়া হলেও এগুলোর প্রতি দর্শকদের অনীহা দেখা যায়। তারিক আনাম খানের দৃষ্টিতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুদানের ছবি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। বেসরকারিভাবে বরং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা বেশি দেখা গেছে। উদাহরণ হিসেবে ‘হাওয়া'র কথা বললেন তিনি। তার কথায়, ‘প্রযোজককে বুঝিয়ে লগ্নি করানোর পর ফল এসেছে। ছবিটি সাড়া ফেলেছে। ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘কোন কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে অনুদান দেওয়া হবে সেটি নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন আগে। যেসব আপত্তি উঠছে সেগুলো সঠিক হয়ে থাকলে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’
এবারের অনুদান পাওয়া ‘জুলাই' ছবির প্রযোজক মাহমুদুল ইসলাম আগে অনুদান পাওয়া নির্মাতা হুমায়রা বিলকিসের স্বামী। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত তার ‘বিলকিস এবং বিলকিস' এখনো মুক্তি পায়নি। এ তালিকা নেহায়েৎ ছোট নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুদানের অর্থ গ্রহণ করা অনেক নির্মাতা এখনও তাদের ছবির শুটিংই শুরু করেননি। এগুলোর ভবিষ্যৎ জানা নেই কারও!
এসব ঘটনায় তারিক আনাম খানের মন্তব্য, ‘‘দায়সারাভাবে কোনও কিছু না করাই ভালো। অনুদান প্রতিবছরই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেওয়া দরকার। সরকারি টাকা যেহেতু, যত স্বচ্ছ থাকা যায় তত মঙ্গল। যারা ফিল্ম বোঝেন, তাদের নিয়েই বাছাই ও চূড়ান্ত কমিটি থাকা উচিত।''
তবে এবার পূর্ণদৈর্ঘ্য যে ১২টি চলচ্চিত্র অনুদান পেয়েছে সেগুলোকে যথাযথ মনে করছেন আকরাম খান। তার আশা, ‘‘এগুলো ঠিকই নির্মাণ হবে। কারণ যারা সত্যিকার অর্থে ছবি নির্মাণ করতে চায়, তারাই আছে তালিকায়। আমার দিনরাত খাটুনি করার একটাই কারণ ছিল— ১২টি নতুন ছবি পাবে দর্শকরা। কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অন্তত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অনুদান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।''
‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ' সরকারি অনুদান প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, সকল কমিটিতে আমলাদের আধিক্য বেশি থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র বোর্ডের সদস্যরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। মাত্র ২-৩ মিনিটের পিচিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নম্বর প্রদান বা বাছাইয়ের কোনো লিখিত মানদণ্ড না থাকায় প্রক্রিয়াটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাই অনুদানের বাছাই কমিটি থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল কমিটিতে আমলাদের পরিবর্তে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের আধিক্য থাকলে সমাধান আসতে পারে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে।
খন্দকার সুমনের দৃষ্টিতে, ‘‘আমলারা সরকারি চাকরি করেন। মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অনৈতিক কিছু বলা হলে সেগুলোর প্রতিবাদ করার সক্ষমতা তারা রাখেন না। ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটি না মেনে উপায় থাকে না তাদের। তাছাড়া আমলাদের পড়াশোনা ও জানাশোনার গণ্ডির সঙ্গে চলচ্চিত্র খাপ খায় না। চলচ্চিত্র দেখলেই কিন্তু চলচ্চিত্র বোঝা যায় না। চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি বুঝতে আলাদা জ্ঞান থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে আমলা এক-দুই জন থাকলেই যথেষ্ট, যারা কমিটিতে থাকা চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সদস্যদের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবেন।''
একই অভিমত আকরাম খানের। তার কথায়, ‘‘কমিটিতে অবশ্যই চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বেশি থাকা ভালো, বিশেষ করে পিচিংয়ে ও নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে। আমলারা শুধুই দাফতরিক কাজের জন্য থাকতে পারেন। তাদের নম্বর দেওয়ার এখতিয়ার না রাখাই শ্রেয়।''
সরকারি অনুদান প্রক্রিয়াকে ঘিরে বিতর্ক ও সমালোচনার শেষ কোথায়? নির্মাতা নূরুল আলম আতিক মনে করেন, ‘‘যতদিন পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র কমিশন গঠন না করা যাচ্ছে, চলচ্চিত্রে অনুদান প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে! জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বেলায়ও তাই। এত বছরে আমরা একটি স্পষ্ট জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা দেখতে পেলাম না! সিনেমার আপন ভাষা তো দূর, বহুদূর!’’ ডয়চে ভেলে