গত ঈদুল আজহা ঘিরে মাত্র ১২ দিনে দেশের সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১২ জন মানুষ। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও এক হাজার ৫৭ জন। সড়কে প্রতিদিন গড়ে ২৬ জনের প্রাণহানির এই চিত্র তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন।
বুধবার (১৮ জুন) সকালে ঈদুল আজহা উদ্যাপনকালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সংগঠনটি ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৩৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে দেশের মানব সম্পদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার ২১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই ক্ষতির পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক দুর্ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসে না।
দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে নারী ছিলেন ৪৭ জন এবং শিশু ৬৩ জন। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১০৭ জন, যা মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। পাশাপাশি, দুর্ঘটনায় ৪৪ জন পথচারী, ৫১ জন চালক ও সহকারীও প্রাণ হারিয়েছেন।
যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল আরোহী, থ্রি-হুইলার ও স্থানীয়ভাবে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের আরোহীদের প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি। ঈদের সময় কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া বাইক চালানো এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ব্যবহার পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলে। ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার ছিল ৫৪ শতাংশের বেশি।
সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে-১৩৬টি (৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ), এরপর আঞ্চলিক সড়কে ১২১টি এবং শহরাঞ্চলে ৫৬টি দুর্ঘটনা।
বিভাগ ওয়ারী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে-১১৬টি দুর্ঘটনায় ৮৭ জন নিহত। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে, যেখানে কোনো মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণে উঠে আসে, এবার ঈদের আগে ও পরে ঢাকা থেকে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ এবং সারা দেশে প্রায় ৪ কোটির বেশি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ছুটি কম থাকায় একসঙ্গে ঘরমুখী মানুষের ঢল নামে। গণপরিবহন সংকটে তারা বাধ্য হয়ে বাসের ছাদে, ট্রাকে, পিকআপে ও ইজিবাইকসহ অনিরাপদ যানবাহনে যাত্রা করেন।
সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিকল হওয়া, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, চালকদের বিশ্রাম হীনভাবে গাড়ি চালানো, যানবাহনের টায়ার ফাটা, ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং বৈরী আবহাওয়া-সব মিলিয়ে এবারের ঈদযাত্রা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক এক অভিজ্ঞতা।
এবারের ঈদযাত্রায় একাধিক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এক পরিবারের সব সদস্য নিহত হয়েছেন এমন ঘটনা ঘটেছে। ছয়টি ঘটনায় বাবা-ছেলে, তিনটিতে স্বামী-স্ত্রী এবং একটিতে মা-ছেলে একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি নিরাপদ ও স্বাভাবিক ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে মধ্য-মেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। এর আওতায় রেলপথ ও নদীপথের উন্নয়ন, বিআরটিসির রুট সম্প্রসারণ, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল বন্ধ, পোশাকশ্রমিকদের ধাপে ধাপে ছুটি প্রদান এবং চালকদের চাকরি সুরক্ষাসহ পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, দেশের সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা এবং কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণেই এই প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা ছাড়া এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।