দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে যাত্রা শুরুর ২ বছরে পায়রায় খরচ ছাড়িয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে এই বন্দর থেকে আয় হয়েছে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকার মতো। বিশাল খরচের বেশিরভাগই গিয়েছে ড্রেজিংয়ে। তবু এর থেকে বড় কোনো সুফল মেলেনি। উল্টো বিপুল খরচে এই বন্দরটি গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
ড্রেজিং প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্পে ব্যয় হয় ৪১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এরপর ২০২৩ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বেলজিয়ামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জান ডি নুলকে নিয়োগ করা হয়। এ অবস্থায় দুই ধাপে ড্রেজিংয়ের পেছনে খরচ হয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
আর ড্রেজিং ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং অবকাঠামো নির্মাণসহ পায়রা বন্দরের পেছনে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৪ কাজার কোটি টাকারও বেশি।
অন্যদিকে, বন্দর চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৫২৯টি বিদেশি এবং ৩ হাজার ৪২৬টি দেশীয় লাইটারেজ জাহাজ পণ্য খালাস করেছে। এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। যা ড্রেজিং ব্যয়েরই এক-তৃতীয়াংশের কম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের প্রকল্পে আগে অবকাঠামো ও ব্যবহারযোগ্যতা নিশ্চিত না করে কেবল গভীরতা বাড়ানোর নামে ব্যয় করলে তা জনসম্পদের অপচয় হয়ে দাঁড়ায়।
পায়রার পরিকল্পনাতেই গলদ
ভৌগলিকভাবে পায়রা বন্দরের অবস্থান এমন এক জায়গায় যেখানে নদীর পানি সমুদ্রে পড়ার আগে প্রচুর পলি ফেলে যায়। এছাড়া নিয়মিত জোয়ার-ভাঁটা ও ঝড়ের কারণে পলি পড়ে। পায়রা বন্দরের পলি নিয়ে ২০১৯ সালে সমীক্ষা চালায় জার্মানি, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের পাঁচজন গবেষকের একটি দল।
তারা জানান, হিমালয় থেকে বছরে ১১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এর মধ্যে পায়রা নদীর ওই চ্যানেলের আশপাশের এলাকায় বছরে ৪০ কোটি কিউবিক মিটার পলি জমা হয়। তখনই বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন সমুদ্রবন্দর করলে পলির কারণে তা নিয়মিত চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
এমন বাস্তবতার মধ্যেও পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়। পরবর্তী সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং চালানো হয়। চরম ডলার সংকটের মধ্যেই ২০২২ সালে রিজার্ভ থেকে নেয়া হয় বিপুল এই অর্থ। ২০২৩ সালের মার্চে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ হস্তান্তর হয়। তখন জানানো হয়, চ্যানেলের গভীরতা বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৫ মিটার, যা ৪০ হাজার ডেডওয়েট টনের জাহাজ চলাচলের উপযোগী।
কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আবারও চ্যানেলে পলি জমে গভীরতা নেমে এসেছে গড়ে ৬ দশমিক ৫ মিটারে। এ বাস্তবতায় এখন আর বড় কোনো বিদেশি জাহাজ ভিড়তে পারছে না বন্দরে।
চ্যানেলে বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারলেও তারা জেটিতে ভিড়তে পারেনি। বাধ্য হয়ে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে হয়েছে আগের মতোই।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, পায়রায় বর্তমান গভীরতা অনুযায়ী, ভাটার সময় এটি গড়ে ৫ দশমিক ৯ মিটার, জোয়ারে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই গভীরতায় বড় কোনো বিদেশি মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে না। ফলে বন্দর ব্যবহারের কার্যকারিতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন।
সুফল না মেলায় ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ
পায়রা বন্দরে সরাসরি মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে না পারায় পণ্য খালাসে লাইটার জাহাজ ব্যবহার করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের, পণ্য পরিবহনে বেড়ে যাচ্ছে খরচ। ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এতে বন্দর ঘিরে বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে পায়রা বন্দরের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে এটা বাস্তবে কাজে লাগাতে হলে নিয়মিত ড্রেজিং এবং টার্মিনাল নির্মাণসহ অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।’
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগে আগ্রহী, কিন্তু তা নির্ভর করছে এই বন্দরের টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর। শুধু কাগজে নয়, বাস্তবেও কার্যকর হতে হবে এসব প্রকল্প।’
ঠেলতে হবে খরচের বোঝা
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও নদী গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, পায়রা বাস্তবিক অর্থে গভীর সমুদ্র বন্দর হয়ে ওঠার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি আমাদের জন্য বিপুল অর্থ অপচয়ের একটি প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। কারণ পায়রা নদীর যে চ্যানেল, যেটিকে আমরা রামনাবাদ চ্যানেল বলছি, সেই চ্যানেল দিয়ে বছরে ৪০ কোটি কিউবিক মিটার পলি আসছে।
এই গবষেকের মতে, বিপুল পলি অপসারণে বছরে প্রায় ৮-১০ হাজার কোটি টাকার মতো খরচ হবে। আর সমুদ্র বন্দরের গভীরতা বজায় রাখতে এই বিপুল পরিমাণ খরচ করতেই হবে। তাই এই প্রকল্পের বিষয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। বন্দর ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে আনষঙ্গিক খরচ এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। তবে খরচের দিকে যেন লুটপাটের প্রকল্প না হয়ে ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান জানান এই গবেষক।
পরিবেশ ও প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কাজ করা পটুয়াখালী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আন নাহিয়ান বলেন, পায়রা বন্দরের আসল সুফল আমরা পাইনি। লুটপাটের মাধ্যমে এই প্রকল্পটি এখনও লাভের মুখ দেখতে পারছে না। গত সরকারের সময় সাড়ে ৬ হাজার কোটি ব্যয়ে ড্রেজিং করা হলেও, লুটপাটের কারণে আমরা বছর না পার হতেই দেখলাম চ্যানেলের গভীরতা কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, জেলাবাসীর পক্ষ থেকে আমরা প্রকল্পের সব ধরনের অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত চাই। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয় এবং সেইসঙ্গে অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, কার্যকর পরিকল্পনা ও প্রয়োগের অভাবে এই প্রকল্প একদিকে যেমন ভেস্তে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে ফেলছে। সময়মতো পুনঃড্রেজিং না হলে ভবিষ্যতেও এই বন্দর ব্যবহারে অনাগ্রহ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক নজরে পায়রার অতীত থেকে বর্তমান
পায়রা বন্দরের চ্যানেল গভীরতা ২০১৬ (প্রাকৃতিক) ছিল ৬.৩ মিটার। ২০২৩ সালে ড্রেজিংয়ের পর তা বেড়ে হয় ১০.৫ মিটার। এক বছর না যেতেই তা কমে দাঁড়ায় ৬.৫ মিটার।
ড্রেজিং প্রকল্পে টার্গেট গভীরতা ছিল ১০.৫ মিটার। লক্ষ্য ছিল ৪০ হাজার ডেডওয়েট টনের জাহাজ চলাচল। বর্তমান বাস্তবতায় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টনের কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল করছে।
ড্রেজিংয়ে ২০২০ সালে ব্যয় হয় ৪১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে খরচ হয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে মোট আয় ২ হাজার ৭৯ কোটি টাকা।