চিংড়ি উৎপাদনে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না খুলনা অঞ্চল। সবশেষ অর্থ বছরেও আগের বছরের তুলনায় কমেছে গলদা ও বাগদা চিংড়ির উৎপাদন। তবে উৎপাদন কমলেও রফতানিতে মিলেছে ইতিবাচক খবর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন ঘাটতি না কাটলে এ প্রবণতা স্থায়ী হবে না।
এক সময় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস ছিল চিংড়ি রফতানি। কিন্তু এখন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান উৎপাদন এলাকা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় চিংড়ি খাত নানা সংকটে পড়ে ধুঁকছে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ১৫ মেট্রিক টন, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় ৯৭ হাজার ৩১৫ টনে। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন কিছুটা বেড়ে হয় ১ লাখ ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন। কিন্তু গত দুই বছর আবার কমতির দিকে।
গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চলের ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৯১ হেক্টর আয়তনের ঘেরে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৬১০ মেট্রিক টন চিংড়ি। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘের ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৪২৩ হেক্টর, উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন কমেছে, আর ঘেরের আয়তন কমেছে প্রায় ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর।
চাষিরা বলছেন, ভাইরাসমুক্ত মানসম্মত পোনা না পাওয়া, অনিয়মিত আবহাওয়া বিশেষ করে খরা ও অতিবৃষ্টি-ঘেরের পানিতে লবণাক্ততার ভারসাম্য নষ্ট করছে। এছাড়া ব্যাংক সহায়তার জটিলতা, প্রশিক্ষণের অভাব ও বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিক্রির অনিশ্চয়তা চাষে আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে।
ডুমুরিয়ার চাষি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার ঘেরে এবার আগের চেয়ে কম চিংড়ি হয়েছে। ঘেরের পানি ঠিক রাখতে পারিনি। পোনা দিতে গিয়েও ভালো জাত পাইনি। এত খরচ করে লাভ তো দূরের কথা, মূলধনও উঠে না।’
আরেক চাষি কৌশিক বাগচি বলেন, ‘মৎস্য অধিদফতর যদি আমাদের দিকে একটু না তাকায় তাহলে আমরা ক্ষতির হাত থেকে বের হতে পারবো না। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ঘেরে চিংড়ি চাষ করি, গত দুই তিন বছরে অবস্থা খুবই খারাপ। চাষের শুরুতেই ভালো পোনা না পাওয়ার কারণে অর্ধেকের বেশি পোনা মারা যাচ্ছে। বছর শেষে লাভের মুখ দেখা তো দূরে থাক, মূলধনই উঠতেছে না। ব্যাংকে ঋণের পরিমাণও বাড়তেছে। এভাবে চলতে থাকলে চিংড়ির চাষ আর করতে পারবো বলে মনে হয় না।’
একই অভিযোগ পাইকগাছার চাষি বিল্লাল সরদারের। তিনি বলেন, ‘সরকার ভাইরাসমুক্ত পোনা দিতে পারলে অনেক উপকার হতো। আমাদের ঘের চালাতে এখন লোকসানে পড়তে হয়। ব্যাংকের সাহায্য চাইলে কাগজপত্রের ঝামেলা আর গ্যারান্টির ভয় থাকে।’
উৎপাদন কমলেও আশার আলো জ্বলে উঠেছে রফতানি খাতে। গত অর্থবছরে এই অঞ্চল থেকে ১৯ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন বেশি। এতে বৈদেশিক আয় হয়েছে ২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা বেশি।
তবে এই অগ্রগতি নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘উৎপাদন না বাড়লে রফতানির এই প্রবণতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। আমরা এখন আগের মজুত বা কিছুটা কৃত্রিমভাবে উৎপাদন তুলে রফতানি করছি, কিন্তু এটি টেকসই নয়।’
প্রতিবছর এই অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ চিংড়ি চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ফলে উৎপাদন হ্রাসের সরাসরি প্রভাব পড়ছে জীবিকা ও স্থানীয় অর্থনীতিতে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে।
মৎস্য অধিদফতরের খুলনা অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল মামুন বলেন, ‘চাষিদের প্রশিক্ষণ, গুণগতমানসম্পন্ন পোনা বিতরণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সহজ শর্তে ঋণের বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্পের প্রস্তাবনা রয়েছে।’
মৎস্য অধিদফতরের মৎস্য ও মান নিয়ন্ত্রণ পরিদর্শক লিপটন সরদার বলেন, ‘আমরা স্থানীয় পর্যায়ে চাষিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছি, সমস্যা চিহ্নিত করছি। এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে উৎপাদনের পাশাপাশি মান বজায় রেখে রফতানির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
চাষি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতের সংকট এখন আর একক সমস্যা নয়। এটি উৎপাদন, বাজার, পরিবেশ ও নীতিগত সহায়তার সম্মিলিত ঘাটতির ফল। তাই টেকসই পরিকল্পনা ছাড়া এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।