বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্য সংঘাত নিরসনের আশায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথমবারের মতো সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসতে চলেছেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়ায় একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য এই বৈঠক করছেন দুই পরাশক্তির কর্মকর্তারা।
এই সংঘাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট, উভয় পক্ষের পদক্ষেপ, এর অর্থনৈতিক প্রভাব এবং জেনেভার আলোচনা থেকে কী প্রত্যাশা করা যায় তার একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো এএফপির প্রতিবেদনে—
দুই দেশ এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে?
যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর দফায় দফায় শুল্ক বৃদ্ধি করেছে, যার ফলস্বরূপ কিছু পণ্যের ওপর মোট শুল্কের হার ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। সামগ্রিক শুল্কের পাশাপাশি, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ি আমদানির মতো নির্দিষ্ট খাতকেও লক্ষ্য করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চীনের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দেশটির মোট রপ্তানির ১৬ দশমিক চার শতাংশ।
বেইজিং এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে এবং মার্কিন পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর চীনে মার্কিন রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৪৩ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। চীন এই ইস্যুতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দ্বারস্থ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘চাপ প্রয়োগের’ অভিযোগ এনে একাধিক অভিযোগ দায়ের করেছে।
এ ছাড়াও, চীন মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর নানা ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বোইংয়ের বিমান কেনার অর্ডার বাতিল, গুগলের বিরুদ্ধে ‘একচেটিয়া আচরণ’-এর তদন্ত শুরু এবং ফ্যাশন জায়ান্ট পিভিএইচ কর্প (টমি হিলফিগার ও কেলভিন ক্লেইনের মালিক) ও বায়োটেক জায়ান্ট ইলুমিনাকে ‘অবিশ্বস্ত সত্তা’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। চীন আধা-পরিবাহী, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স তৈরিতে অত্যাবশ্যকীয় বিরল খনিজ উপাদানের রপ্তানির ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ২৯৫ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার, যা দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন প্রশাসনের উদ্বেগের কারণ। চীনা নেতৃত্ব এতদিন ধরে এই বাণিজ্য ভারসাম্যের পরিবর্তন চায়নি। তবে, বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হলে চীন ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রপ্তানির ওপর আর আগের মতো নির্ভর করতে পারবে না, যেখানে ২০২৪ সালে দেশটির রপ্তানি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক চীনের কোভিড-পরবর্তী দুর্বল অর্থনীতি, ভূসম্পত্তি খাতের ঋণ সংকট এবং দুর্বল ভোক্তা ব্যয়ের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
অন্যদিকে, এই বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রেও অনুভূত হচ্ছে। গত মাসে দেশটির শিল্পখাতে উল্লেখযোগ্য ধস নেমেছে এবং অর্থনীতিবিদরা প্রথম প্রান্তিকে অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সংকোচনের জন্য এই শুল্কযুদ্ধকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
রাবোব্যাঙ্কের সিনিয়র চীন অর্থনীতিবিদ টিওয়ে মেভিসেন এএফপিকে বলেন, ‘দুই দেশই এখন উপলব্ধি করতে পারছে যে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া সহজ নয়। বর্তমান বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি যদি কোনো একটি পক্ষ কৌশলগত সুবিধাও অর্জন করে, তবুও তারা যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থার তুলনায় খারাপ অবস্থানে থাকবে।’
এপ্রিল মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রধান সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান এই সংঘাতের কারণে দেশ দুটির মধ্যে পণ্য বাণিজ্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। চীনের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি সুদের হার একাধিকবার কমানো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির অর্থনীতিতে শুল্কযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের একটি বড় ইঙ্গিত। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এই শুল্ক চীনের জিডিপি থেকে একটি বড় অংশ কেটে নিতে পারে, যেখানে এই বছর চীনা নেতৃত্ব পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ইলেকট্রনিক্স, যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল ও পোশাকের মতো যুক্তরাষ্ট্রে চীনের প্রধান রপ্তানি খাত এই ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে, চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শিল্প ও ভোক্তাদের ব্যাপক নির্ভরশীলতার কারণে এই শুল্ক শেষ পর্যন্ত আমেরিকান উৎপাদক ও ভোক্তাদেরও আঘাত হানতে পারে বলে বিশ্লেষকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
আলোচনার অগ্রগতি কি সম্ভব?
উভয় দেশই প্রকাশ্যে দাবি করছে যে, অর্থনৈতিক চাপের কারণেই প্রতিপক্ষ আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে। যদিও বাজার এই বৈঠকের খবরকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে, তবুও জেনেভায় কোনো বড় ধরনের অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীন ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথমত আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে এবং তাদের এই অবস্থান ‘অপরিবর্তিত’ থাকবে। একই সঙ্গে, তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ‘প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’ থাকার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, এই বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য হবে ‘উত্তেজনা প্রশমন’, কোনো ‘বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি’ নয়। তবে, বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি ক্ষীণ আশা রয়েছে। শনিবারের (১০ মে) প্রাথমিক আলোচনার পর কিছু সুনির্দিষ্ট শুল্ক কমানোর ঘোষণা আসতে পারে।
জার্মান মার্শাল ফান্ডের ইন্দো-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনি গ্লাসার এএফপিকে বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড আলোচনার একটি সম্ভাব্য ইতিবাচক ফলাফল হতে পারে এ বছর আরোপিত অধিকাংশ শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা।’
এশিয়া সোসাইটির লিজি লি মনে করেন, ‘একটি প্রাথমিক, প্রতীকী পদক্ষেপের’ সম্ভাবনা রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হবে উত্তেজনা কমানো, কোনো মৌলিক সংঘাতের সমাধান নয়। তিনি আরও বলেন, ‘স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং একটি নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো স্থাপন করাই সম্ভবত এই আলোচনার সবচেয়ে প্রত্যাশিত ফল হতে পারে।’