
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃঢ়তা, আপসহীনতা ও গণমানুষের অধিকারের প্রশ্নে অটল থাকার প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিচল অবস্থান, শালীন কথাবার্তা, মার্জিত আচরণ এবং বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আত্মত্যাগ তাকে গড়ে তুলেছে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্রে।
তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। জনপ্রিয় এই নেত্রী ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা চন্দনবাড়ির মেয়ে তৈয়বা মজুমদার আর পিতা ফেনীর ফুলগাজির ইস্কান্দার মজুমদার।
দিনাজপুরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়ার দম্পতির দুই সন্তান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মরহুম আরাফাত রহমান কোকো।
যুদ্ধ, বন্দিত্ব ও সংগ্রাম
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার সময় দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আত্মগোপনে ছিলেন খালেদা জিয়া। ২ জুলাই তাকে দুই সন্তানসহ গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সেনারা। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর মুক্তি পান তিনি।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর সাধারণ গৃহবধূ খালেদা জিয়া দলীয় নেতাকর্মীদের দাবিতে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে সাতদলীয় ঐক্য গড়ে তুলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনের কারণে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখনই তিনি পান ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবদান
১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া। তার আমলে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়, কর্মসংস্থানের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে এবং তৈরি পোশাক খাতে প্রায় দুই লাখ নারী যুক্ত হন। তিনি গঙ্গার পানি-বণ্টন, রোহিঙ্গা সংকটসহ আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটকে নেতৃত্ব দিয়ে আবারও সরকার গঠন করেন। নারী শিক্ষা বিস্তার, সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধি, ফ্রি প্রাথমিক শিক্ষা, ও শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ—এসব তার সরকারের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৫ সালে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
ওয়ান ইলেভেনের নিপীড়ন ও পরবর্তী সময়
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনে সেনাসমর্থিত সরকারের সময় খালেদা জিয়া ও তার পরিবার ভয়াবহ নিপীড়নের সম্মুখীন হয়। তাকে সাব-জেলে বন্দি করা হয়, তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় হত্যাচেষ্টা, আর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো জেল-নিপীড়নে অসুস্থ হয়ে পরবর্তীতে মারা যান।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে জিয়া পরিবারকে লক্ষ্য করে ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধের’ ধারাবাহিকতা শুরু হয়। জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও উন্নত চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্ত হন বেগম জিয়া।
জনভরসার প্রতীক
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বন্দিত্ব, অসংখ্য ষড়যন্ত্র ও বাধা মোকাবিলা করে খালেদা জিয়া নিজের অবস্থান অটুট রেখেছেন। নির্বাচনে একাধিক আসনে জয়, গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি তাকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছে।
গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রনায়ক—বেগম খালেদা জিয়ার পথচলা বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অনুপ্রেরণীয় অধ্যায়। বিপর্যয়ের মধ্যেও জনগণের ভরসাস্থল হয়ে উঠে তিনি প্রমাণ করেছেন, দৃঢ় মনোবল ও বিশ্বাস থাকলে ইতিহাসের কঠিনতম সময়ও জয় করা যায়।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া, কারাভোগ করেছেন। চিকিৎসার সুযোগও দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বেগম জিয়া। এরপর করোনার কারণে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিলেও গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় বন্দি রাখা হয়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে চিকিৎসা না পাওয়ায় ধীরে ধীরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয় খালেদা জিয়ার।
এরমধ্যে ২০২৪ সালের জুলাইতে কোটা সংস্কার আন্দোলন দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন, যা শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে গড়ায়। টানা ৩৫ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। পরদিন ৬ আগস্ট খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। ১১৭ দিন লন্ডনে অবস্থান শেষে গত ৬ মে তিনি দেশে ফেরেন। তার স্বাস্থ্যের অনেকটা উন্নতি হয়েছিল। তবে নানা রোগে জটিলতা ও শরীর–মনে ধকল সহ্য করে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও ছিল প্রতিকূল। প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাসপাতালে ভর্তি করানো হতো।
সবশেষে গত ২৩ নভেম্বর তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক মাসের কিছু বেশি সময় তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।